দেশজুড়ে নিয়ন্ত্রণহীন মাদকাসক্তির বিস্তৃতি ক্রমেই হয়ে উঠেছে সর্বগ্রাসী। এই ভয়াল মাদকাসক্তি তারুণ্য, মেধা, বিবেক, লেখাপড়া, মনুষ্যত্ব- সবকিছু ধ্বংস করে দিচ্ছে। বিনষ্ট করে দিচ্ছে স্নেহ-মায়া, ভালোবাসা, পারিবারিক বন্ধন পর্যন্ত। মাদকাসক্ত সন্তানের হাতে বাবা-মা, ঘনিষ্ঠ স্বজন নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হচ্ছে, নেশাখোর পিতা মাদক সংগ্রহে ব্যর্থ হওয়ার ক্রোধে নিজ সন্তানকে খুন করছে অবলীলায়। নেশার টাকা না পেয়ে স্ত্রীকে আগুনে পুড়িয়ে মারা, মাকে জবাই করা, আদরের সন্তানকে বিক্রি করে দেয়ার মতো অমানবিক ঘটনাও ঘটছে।
এক অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ১০ বছরে নেশাখোর ছেলেদের হাতে অন্তত ২০০ জন বাবা-মা নৃশংসভাবে খুন হয়েছে। একই সময়ে মাদকসেবী স্বামীর হাতে প্রাণ গেছে আড়াই শতাধিক নারীর। এমনকি খোদ রাজধানীতেই মাদকসেবী কিশোরী মেয়ের হাতে পুলিশ অফিসার বাবা ও গৃহিণী মা খুনের ঘটনা নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় হয়। পুলিশের একাধিক প্রতিবেদনেও মাদকের জের হিসেবে অপরাধ বৃদ্ধির ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। ইদানীং মাদকাসক্তির কারণেই চাঁদাবাজি, ছিনতাই-রাহাজানি, ডাকাতি ও খুন-খারাবির ঘটনা বেশি ঘটছে বলেও গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। পুলিশ, র্যাব, ডিবি ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর মাঝে-মধ্যে অভিযান চালায় ঠিকই, তবে বেশিরভাগ অভিযানই চলে টু-পাইস কামানোর ধান্ধায়। আবার অভিযানের মাধ্যমে যেসব মাদক উদ্ধার হয় এর সিংহভাগই পুলিশের হাত ঘুরে মাদক ব্যবসায়ীদের কাছেই চলে যায়। ফলে একাধারে অভিযানও যেমন চলে, তেমনি মাদকের কেনাবেচাও চলে পাল্লা দিয়ে, শুধু বেড়ে যায় দরদাম। চারদিকেই মাদকের ছড়াছড়ি। স্কুল পড়ুয়ারাও এখন ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিলে আসক্ত হয়ে পড়েছে। এখন টিফিনের টাকা একত্র করে সহপাঠীরা মিলেমিশে হেরোইন-ইয়াবা সেবন করলেও- টাকা না পেলেই তারা শুঁকছে জুতায় লাগানোর পেস্টিং গাম। কী রাজধানী, কী শহর-বন্দর-গঞ্জ- হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে চোলাই মদ, গাঁজা, ইয়াবা, ইনজেকশন, হেরোইন, আফিমসহ বিভিন্ন মাদক। এখন উপজেলা পর্যায়েও একাধিক পয়েন্টে চলে মাদকের কেনাবেচা। যাদের টাকার জোর কম তারাও হাতুড়ে পদ্ধতিতে তৈরি করছে ভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য। বিভিন্ন কাশির ওষুধ সিরাপের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে তৈরি করা এ নেশাদ্রব্য ‘ঝাঁকি’ বা ‘ঘুটা’ নামেই বেশি পরিচিতি। ঘুটা তৈরির সবকিছু পাওয়াও যায় সহজেই। দামেও কম। সহজলভ্য মদ-গাঁজা আর নিজেদের তৈরি ঘুটার পাশাপাশি অননুমোদিত একান্তবাস উত্তেজক নেশাজাতীয় কথিত কোমল পানীয় (এনার্জি ড্রিংক) দ্বারাও নেশা করছে তরুণ-তরুণীরা। নেশার সর্বগ্রাসী থাবা সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্যাম্পাস থেকে শুরু করে মাধ্যমিক স্কুলের গ-ি পর্যায়েও মাদকের ভয়াল অভিশাপ নেমে এসেছে। সহজলভ্যতা, বেকারত্ব বৃদ্ধি, কালো টাকার আধিক্য, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ ইত্যাদি কারণে মাদকাসক্তের মিছিল দিন দিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর গত কয়েক মাসে কয়েক হাজার পিস ইয়াবাসহ বিক্রেতাদের আটক করেছে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে র্যাব-পুলিশ সদস্যরা অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধার ও ব্যাপারি পর্যায়ের মাদক সরবরাহকারীদের আটক করে থাকে। টেকনাফ-কক্সবাজার, চট্টগ্রাম এলাকায় অভিযানে নামলেই মিলছে লাখ লাখ পিস ইয়াবা। তারপরও ইয়াবার নেশাকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক পরিদর্শক জানায়, ইয়াবা বাণিজ্যের সঙ্গে প্রভাবশালী লোকজন জড়িত। কেউ বেশি সংখ্যক ইয়াবা নিয়ে আটক হলেই ভিআইপি শ্রেণীর প্রভাবশালীরা তাদের ছাড়িয়ে নিতে তদবির করে থাকে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক নেতারাই নিয়ন্ত্রণ করছে মাদক বাণিজ্য। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে মহানগর, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়ের অনেক নেতা-কর্মী-সমর্থক সরাসরি মাদক কেনাবেচা করছে। ইউনিয়ন পর্যায়ের কাউন্সিলর থেকে শুরু করে ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান, কতিপয় জাতীয় সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধেও মাদক কেনাবেচাসহ সরবরাহ কাজে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ভারতের বাংলাদেশ সীমানা সংলগ্ন এলাকায় প্রায় তিনশটি বড় ধরনের ফেনসিডিলের কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় উৎপাদিত ফেনসিডিল নেশার উপযোগী করে তুলতে উচ্চমাত্রার রাসায়নিক (কোডিন ফসফেট) মেশানো হচ্ছে। ভারত থেকে বছরে কমপক্ষে এক কোটি বোতলে বিশেষ ধরনের এই ফেনসিডিল বাংলাদেশে ঢুকছে। সম্প্রতি দীর্ঘ অনুসন্ধান চালিয়ে মালিকের নাম-ঠিকানাসহ সীমান্তবর্তী ফেনসিডিল কারখানাগুলোর সুনির্দিষ্ট অবস্থান শনাক্ত করে একটি তালিকা তৈরি করে বিএসএফ’কে হস্তান্তর করা হয়েছে। তালিকাটি বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও পাঠানো হয়।
সূত্র থেকে জানা যায়, তালিকায় মোট ১০০টি ফেনসিডিল কারখানার বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে ভারতের ত্রিপুরার সীমান্তেই ১০টি কারখানা রয়েছে।
তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছে ত্রিপুরার সোনামুরা বাজারের তিনটি ফেনসিডিল কারখানার। সীমান্তের জিরো পয়েন্ট থেকে এই তিন কারখানার দূরত্ব মাত্র ৪শ মিটার। এ কারখানায় উৎপাদিত ফেনসিডিল গোলাবাড়ী ও বিরিবাজার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে। ত্রিপুরার বিকাশনগর (আজিমপুর) ও মধুপুর পাহাড়ি এলাকায় রয়েছে দুটি কারখানা। এছাড়া পশ্চিম ত্রিপুরার গান্ধিগ্রামে একটি কারখানার অবস্থান। দক্ষিণ ত্রিপুরার শ্রীরামপুরে একটি কারখানায় উৎপাদিত ফেনসিডিল ফেনী সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে। বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে মাত্র ৬ মিটার দূরত্বে শ্রীরামপুরের সিদ্ধিনগর এলাকায় একটি কারখানার অবস্থান। মূলত, ভারতের বাংলাদেশ সীমানা সংলগ্ন এলাকায় ফেনিসিডিল কারখানা স্থাপনই করা হয়েছে বাংলাদেশে পাচারের জন্য।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, শুধু ভারত-মিয়ানমার সীমান্তের চার শতাধিক রুটের ৬১২টি পয়েন্ট দিয়েই ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক ঢুকছে। মাদক পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে কুমিল্লা-চান্দিনা রুট, আখাউড়া রেলওয়ে জংশন, বেনাপোল বন্দর, শেরপুর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা, নেত্রকোনা, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার এবং দিনাজপুরের সীমান্তপথ ও বুড়িমারী-বাংলাবান্ধা-হিলি বন্দর।
জানা গেছে, দক্ষিণাঞ্চলের ছয় জেলার মধ্যে সাতক্ষীরায় ২৬টি, যশোরে ২১টি, ঝিনাইদহে ২২টি, চুয়াডাঙ্গায় ৬টি, মেহেরপুরে ২২টি ও কুষ্টিয়ায় দুটি রুট রয়েছে। সিলেট বিভাগের প্রায় ৭০০ কিলোমিটার সীমান্তে শতাধিক আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৮০ কিলোমিটার সীমান্তে রয়েছে অর্ধশতাধিক স্পট। নাটোরের লালপুর থেকে নওগাঁর ধামুইরহাট পর্যন্ত প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকায় ২৭টি রুটে ২২০টি পয়েন্ট দিয়ে অবাধে মাদকের চালান ঢুকছে। শেরপুরের অন্ততঃ ১৮টি পয়েন্টসহ ভোগাই, মহারশি, চেল্লাখালী সোমেশ্বরী সীমান্ত নদী দিয়ে মাদক আসছে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, বেনাপোল, হিলি, কুমিল্লার চান্দিনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া রুট দিয়ে প্রতিদিন ১০ কোটি টাকার মাদকদ্রব্য দেশে ঢুকছে। ইয়াবা ও ফেনসিডিল ছাড়া অন্য সব মাদকের বেশির ভাগই অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মাফিয়ারা দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর এবং ঢাকা হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে মাদক পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।
অবৈধ পন্থায় মাদক আমদানির জন্য প্রতি বছর দেশ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি পাচার হয়ে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে মাদকের অবৈধ আমদানিকারকের সংখ্যা। এছাড়া বৈধ আমদানিকারকরাও বৈধ লাইসেন্সের আড়ালে অবৈধভাবে মাদক দেশে আনছে। হেরোইন, মদ, ইয়াবা, আইসপিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক অবৈধভাবে বিদেশ থেকে আনা হচ্ছে। এসব মাদকের মধ্যে সর্বোচ্চ ১০ ভাগ উদ্ধার করতে পারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। বাকি ৯০ ভাগই স্থানীয় মাদকসেবীরা সেবন করে। এই হারাম ব্যবসাটি অত্যন্ত লাভজনক হওয়ায় সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারীরাও এই ব্যবসায় অর্থ লগ্নী করে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও র্যাবের হিসাব থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে মাদকের অন্তত ৩৫ হাজার মামলা বিচারের অপেক্ষায় ঝুলে আছে।
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে অনেক নারী মাদকসেবীর সংখ্যা। আর মাদকসেবীদের মধ্যে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ক্যান্সার। নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি সাড়ে ৬ সেকেন্ডে মারা যাচ্ছে একজন করে মাদকসেবী।
রুট চিহ্নিত হলেও ঠেকানো যাচ্ছে না মাদকের আগ্রাসন। কখনো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্যদের চোখে ধুলা দিয়ে, কখনো-বা ম্যানেজ করে সীমান্তবর্তী চার শতাধিক রুট দিয়ে অবাধে মাদক ঢুকে পড়ছে। পরে তা ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত করার পাশাপাশি মাদক ধ্বংস করছে দেশের মানবসম্পদকে। মাদকের মরণনেশায় জড়িয়ে পড়ছে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ। অভিযোগ রয়েছে, আন্তর্জাতিক মাদক চোরাকারবারীরা বাংলাদেশকে মাদক পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবেও ব্যবহার করছে।
পর্যবেক্ষক মহল জানায়, ১৯৯০ সাল থেকে যদিও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর কাজ করছে, কিন্তু আইন প্রয়োগের অভাব এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দুর্নীতিপরায়ণতার কারণে এদেশে মাদকের অপব্যবহার বাড়ছে। এক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা অন্ধ, বোবা আর বধিরের মতোই। উল্লেখ্য, সম্প্রতি একটি ফ্যাশনযুক্ত শ্লোগান উঠেছে, ‘মাদককে না বলো।’ অথচ পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদের মধ্যে মাদকের বিরুদ্ধে যা বলা আছে তার প্রচারে মুসলমানের অন্তরে এমনিতেই দাগ কাটার কথা।
মূলত, মাদকের বিরুদ্ধে পবিত্র ইসলামী অনুভূতি ও প্রচার এক সময় জোরদার ছিল। কিন্তু ইদানীংকালে ধর্মব্যবসায়ী তথা উলামায়ে ‘সূ’দের নিষ্ক্রিয়তা সে মূল্যবোধকে নিস্তেজ করে দিয়েছে। হালে মুজাদ্দিদে আ’যম সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুল উমাম আলাইহিস সালাম উনার সুমহান ক্বওল শরীফ ও উনার লেখনী সে অবলুপ্ত অনুভূতিতে জাগরণ তৈরি করছে। তবে এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, মুজাদ্দিদে আ’যম, রাজারবাগ শরীফ উনার মামদূহ হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা আলাইহিস সালাম তিনি শুধু তাত্ত্বিক ফতওয়াই দিচ্ছেন না; পাশাপাশি দিচ্ছেন মাদক থেকে বিরত হওয়ার বেমেছাল রূহানী কুওওয়াত মুবারক। যা মাদকসেবীদের আনন্দের সাথেই মাদক থেকে বিরত রাখছে।